Friday, January 1, 2021

সঙ্গদোষ__ফেরদৌস হাসান মিঠুন

সঙ্গদোষ


আকাশ ফুঁড়ে বেরিয়ে আসা হলুদ আলোয় ঝকঝক করছে বাঁশ ঝাড়টা। চাঁদ উঠেছে। এ যেন পূর্ণিমা রাতের কষ্টি পাথর। যেদিকেই তাকায় উজ্জ্বল সোনালী আলোয় আলোকিত হয়ে উঠছে। হুতোম প্যাচাটা এখান থেকে ওখানে লাফিয়ে বেড়াচ্ছে। মৃদুমন্দ হিমেল বাতাস উত্তর পূর্ব দিক থেকে ধেয়ে আসছে। দুটো বাঁশ কড়াৎ কড়াৎ শব্দ তুলে নড়ে উঠলো। চমকে উঠল ছেলেটি। রাত এগারোটা। ছেলেটি গিয়েছিল হলে সিনেমা দেখতে। শো শেষ হয়েছে রাত ৯ টায়। বয়স বাড়ন্ত, অবিবাহিত, সবে বয়ঃসন্ধিতে পা দিয়েছে। ছবি দেখা একটা নেশার মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০০৪ সাল, বাংলাদেশ চলচ্চিত্রের অন্ধকার যুগ। উঠতি বয়সের ছেলেদের মাথা খারাপ হ‌ওয়ার জোগাড়। যেই হলের বাইরে বেরিয়েছে অমনি আকাশ ছিদ্র হয়ে বারি বর্ষণ শুরু হয়ে গেলো। ছেলেটি একটা গাছের সাথে সাইকেলটি হেলান দিয়ে রেখে দৌড়ে ঢুকলো একটা দোকানে। আশেপাশে সব দোকান‌ই বন্ধ হয়ে গেছে। শুধু এই চায়ের দোকানটাই খোলা আছে। দোকানদার নিজেও আটকা পড়েছে। পূর্ণিমা রাতের বৃষ্টি। আকাশ নিকষ কালো অন্ধকারে ছেয়ে আছে। চাঁদটা মেঘের আড়ালে পড়ে বিলীন হয়ে গেছে। পূর্ণিমা রাতে অমাবস্যা নেমে আসলো যেন। কি অদ্ভুত দৃশ্য !

টিনের চালার উপর ঝপাঝপ বৃষ্টির মস্ত ফোঁটাগুলো তীক্ষ্মভাবে বিঁধছে। যেন চাল ফুটো করে ছেলেটিকে ভিজিয়ে দেবে। ছেলেটি আচ্ছন্ন, বিমোহিত হয়ে ভাবতে লাগলো হলের সেই নায়ক নায়িকার জড়িয়ে ধরার দৃশ্য গুলো। অনেকবার মাথা ঝাঁকিয়ে চিন্তা দূর করার চেষ্টা করেও কোন লাভ হলো না। জীবনের একটা সময় মানুষের মন বেয়াড়া হয়ে উঠে। শরিফ এই সময়ের মধ্য দিয়েই যাচ্ছে। বাঁধভাঙা জোয়ারে নিজেকে ভাসিয়ে দিতে মন চাচ্ছে। কল্পনার রাজ্যে অনেক কিছুই করে বেড়ায় ছেলেটি। তখন অস্বস্তি আর ভালো লাগা মিলে শরীরটা পিট পিট করতে থাকে।

এতক্ষণ দোকানদার একটি কথাও বলে নি। হঠাৎ ছেলেটিকে সচকিত করে দিয়ে বলে উঠলো, "নাম কি?"

ছেলেটি আমতা আমতা করে জবাব দিলো, " জ্বী,,, শরিফ।" কিছুক্ষণ নিরবতা। দোকানদার আবার জিজ্ঞেস করল,"ক‌ই থেইকা আইতাছো এত রাইতে? বাড়ি ক‌ই তোমার?"

শরিফ ভাবলো সিনেমা হলের কথা বলা যাবে না, তাহলে কি বলবো? কি বলবো? "হ্যা, গেছিলাম এক আত্মীয় বাড়ি। আমার বাড়ি হিরণগাছী। খালার বাড়ি থেকে আসতে আসতে রাত হয়ে গেলো।" পাশেই হঠাৎ একটা বিকট শব্দে বজ্রপাত হতেই ছেলেটি লাফিয়ে উঠলো। দোকানদার বুঝলো ছেলেটি মিথ্যা বলছে। এত রাতে কোন আত্মীয়‌ই এইটুকুন ছেলেকে ছেড়ে দেবে না। তা হলেও দোকানদার আর কিছু জিজ্ঞাসা করার আগ্রহ দেখালো না।

টানা একঘন্টা বাঁধভাঙা বৃষ্টি শেষে কালো মেঘ কেটে গিয়ে চাঁদটা ঠিকরে বেরিয়ে এসেছে। মনেই হচ্ছে না, এই একটু আগে অমন ঠাটানো বৃষ্টি হয়ে গেছে। শরিফ পুরাতন হিরো সাইকেলটি নিয়ে পেড়েলে সজোরে পা লাগালো। আধঘন্টাতেই পৌঁছে গেলো খুনি বটতলার কাছে। জায়গাটা দিনের বেলাতেও বিভৎস অন্ধকারাচ্ছন্ন থাকে। চারদিক ঘন বাঁশ ঝাড়, তেঁতুল আর বট গাছে ঘেরা। আড়ার মধ্য দিয়ে সরু একটা রাস্তা সামান্য বাঁক নিয়ে উত্তর দক্ষিণ দিকে বিস্তৃত হয়ে গেছে। রাস্তা ধরে দক্ষিণে শরিফদের বাড়ি। আধঘণ্টার পথ।

শরিফ রাস্তার মাঝে আসতেই বাঁশের অমন কড়াৎ শব্দে আত্মা উবে গেলো। জায়গাটা ভালো না, একথা সে আগেও শুনেছে। স্নায়ু টনটন করে উঠলো, হাত পা নিথর হয়ে পড়ছে, সাইকেলের পেড়েল ঘুরছে না, যেন পড়ে যাচ্ছে। হঠাৎ কোথা থেকে একটা উষ্ণ বাতাসের ঝাপটা লাগলো। আধখোলা বিবর্ণ আলুথালু চোখে সামনে তাকালো। চোখের সামনে কালো এক ছায়ামূর্তি। কি ওটা? কোন গাছের ছায়া নয় তো? হ্যাঁ, গাছের ছায়াই হবে হয়ত। পরক্ষণেই ছায়ামূর্তিটা যেন কাছে ডাকার ভঙ্গিতে নড়ে উঠলো। সর্বনাশ ! শরিফ গলা ফাটিয়ে চিৎকার দিতে যাচ্ছিল, পারলো না। একি, কন্ঠ বসে গেছে! কথা বলছে কিন্তু কোন শব্দ হচ্ছে না। চোয়াল আড়ষ্ট, চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। যেন মারা যাচ্ছে। বুকের মধ্যে ড্রাম বাঁচতে শুরু করলো যেন হ্যামারের একেকটা আঘাতে হৃদপিন্ডটা বুকের খাঁচা ভেঙে লাফিয়ে বেরিয়ে আসবে। জায়গাটা সম্পর্কে আগে যা শুনেছে, তবে কি আজ সত্যি ঘটতে চলেছে? তাও আবার তার নিজের সাথেই? আর কিছু ভাবতে পারলো না।

অতি কষ্টে আল্লাহর নাম স্বরণ করতে লাগলো। আয়াতুল কুরসি টা মুখস্থ নেই। "আল্লাহ এই বারের মতো বাঁচিয়ে দাও। আল্লাহ, আল্লাহ, আল্লাহ...। আল্লাহ, আর জীবনে কখনো এমন ছবি দেখতে যাবো না। মাফ করো খোদা। "

আশ্চর্য ! মনে একটু একটু করে জমাট বাঁধা ভয় কেটে যেতে লাগলো। ধর্মীয় বিশ্বাস, মানসিক শক্তির রূপায়ক। নিউরোনে তরঙ্গের জোয়ারে ভাটা পড়েতে লাগলো। মাটিতে উবু হয়ে পড়ে থাকা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে টেনে সাইকেলটি তুললো। হাত পা তখনো পৌষ মাসের তীব্র শীতের মতো ঠকঠক করে কাঁপছে। বুকের বাঁ পাশটা ব্যথায় টনটন করছে। বাড়ি যখন ফিরলো রাত বারোটা। মা ঘুমিয়ে পড়েছে, দরজায় খিল পড়েনি।

ভয়ে এড্রেনালিন এতটাই ক্ষরণ হয়ে গেছে বুঝতেই পারে নি যে ছোট ঘর চেপেছে। বাইরে যাওয়ার সাহস পাচ্ছে না। মাকে ডাকা যাবে না। বকার তুবড়ি ছুটবে। কোন রকম বাইরে গিয়ে উঠোনের মাটির তৃষ্ণা মিটিয়ে ছুটে ঘরে চলে এসে কাঁথা মুড়ে শুয়ে পড়লো। সে রাত কিছু হলো না। ক্লান্ত, অবসন্ন ভাবটার জন্য‌ই হয়তো মরার মতো ঘুমালো পরেরদিন দুপুর নাগাদ।

ঘটনাটা মাকে বলে নি। সময় চলছে সময়ের মতো। দিনের পর দিন শরিফ শুকিয়ে যাচ্ছে। ইদানিং রাতে ভয়ঙ্কর কিছু স্বপ্ন দেখছে। প্রতিটি স্বপ্নের ধারা এক‌ই। প্রথমে যাই দেখুক না কেন, শেষ হয় ঐ একটি ছায়ামূর্তি দিয়ে, সেই হাতছানি দিয়ে ডাকা, সেই দুল খাওয়া। অস্বস্তি,ভয় আর ক্লান্তি নিয়ে ঘুম ভাঙ্গে প্রতিটা রাত।

ঘটনার দশদিন পর, শরিফ রোগা, বিবর্ণ আর লাবণ্য হারিয়ে ফেলতে লাগলো। মা খুব চিন্তিত ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করে, " বাবা, কি হয়েছে তোর? এমন হয়ে যাচ্ছিস কেন?" শরিফ কিছু বলে না। সিনেমার কথা বললে যে আর রক্ষে নেই। ডাক্তার, কবিরাজেও কাজ হচ্ছে না। এলাকার বিখ্যাত শানু কবিরাজের কাছ থেকে ঘটা করে পানি পড়িয়ে এনে খাওয়ালো। অবস্থা যেই সেই। মা ভেঙে পড়ছেন।

বুধবার মধ্যরাত, শরিফ চিৎ হয়ে শুয়ে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। হঠাৎ কি যেন বুকের উপর এসে চেপে বসলো। যেন পুরো পৃথিবীটা কেউ বুকের খাঁচার উপর তুলে দিয়েছে। শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসছে। শরিফ প্রাণপণ চেষ্টা করছে উঠে বসার জন্য, পারছে না। চিৎকার করে মাকে ডাকছে, মা পাশেই কাজ করছে। কিন্তু শুনতে পারছে না। অনেক ধ্বস্তাধ্বস্তির পর হঠাৎ যেন বুকটা হালকা হয়ে গেলো। শরিফ লাফ দিয়ে উঠে বসলো, দেখলো শরীর ঘেমে বিছানা ভিজে গেছে। বুকের ভেতর একদলা মাংসপিণ্ড নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বিরামহীনভাবে লাফিয়ে চলেছে। জীবনটা অসহ্য হয়ে উঠেছে। অতটুকুন ছেলে জীবনে তো অনেক কিছু করার বাকি,অনেক অভিজ্ঞতা বাকি। শরিফ আবার ধড়াস করে শুয়ে পড়লো। ঘরের কড়িকাঠের দিকে চোখ পড়লো। আত্মাটা আবার ছাৎ করে উঠলো। যেন দুটো সবুজ চোখ এখন‌ই জ্বলে উঠে নিভে গেলো। চিৎকার দিতে যাবে, তখনই চোখ দুটো অদৃশ্য হয়ে গেল। কাঁথাটা নাকে মুখে টেনে ঘাপটি মেরে চোখ বুজে র‌ইলো। আর কোন দিকে তাকাতে চায় না।

পরের দিনটি স্বাভাবিক ভাবেই কাটলো। শরিফকে শান্ত, ভাবলেশহীন দেখালেও দুপুর ও রাতে খেয়েছে। রাত যত গভীর হয়, ভয় তত জেঁকে বসে। আর রাতে ঘুমাতে চায় না, রুমের লাইট জ্বালিয়ে‌ই রাখবে এখন থেকে। রাত ১ টা পার হয়ে গেছে, শরিফ আর পারছে না। সম্মোহিতের মতো চোখ বসে যাচ্ছে। গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল মুহুর্তেই।

বুক ফাটা তীক্ষ্ম আর্থ চিৎকারে মায়ের ঘুম ভেঙ্গে গেল। হুড়মুড় করে উঠে পাগলের মতো ছুটে গেলো ছেলের রুমের দিকে। জানালাটা খোলা। সেদিক দিয়ে তাকাতেই যা দেখলো, বুকের রক্ত হিম হয়ে গেল। শিরদাঁড়া বেয়ে বরফ শীতল স্রোত তির তির করে নিচে বয়ে যাচ্ছে। ভয়ে, আতঙ্কে চোখ বুজে বসে পড়লো। 

শরিফ হা করে নিঃশ্বাস নেয়ার চেষ্টা করছে, হাত পা ছুটোছুটি করছে কিন্তু আশ্চর্য ! বুকের অংশটুকু পাথরের মতো স্থির। বিছানাটা উন্মত্তের মতো যেন অন্য কেউ ঝাকাচ্ছে। নাভিশ্বাস উঠে গেছে যেন। এমন দৃশ্য জগতের কোন মা ই সহ্য করতে পারবে না। দৌড়ে দরজা খুলে ঘরে ঢুকে ছেলেকে ধাক্কা দিয়ে পাশ ফিরিয়ে দিল। বিছানাটা তখন‌ও কাঁপছে। কিছুক্ষণ পর থেমে শান্ত হয়ে এলো।

পরেরদিন রাতের ঘটনার কথা বলতেই মা আতঙ্কের সুরে বললো, " হায় হায়! বলিস কি! তরে তাইলে বোবায় ধরছিলো। বোবা বুকের উপর এসে বসে নিঃশ্বাস আটকাইয়া মানুষ মাইরা ফালায়। তুই আইজ থেইকা আমার এইখানে থাকবি।" 

ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতেই চিন্তার ওষধ দিল। অবস্থা কিছুটা ভালো হলো মনে হয়। ভবঘুরের মতো ঝিম মেরে বসে থাকে না। 

মানুষ যখন প্রাণ সংশয়ে থাকে অনেক সাহসী বীর‌ও ভয়ে কাচুমাচু হয়ে যায়। আর শরিফ তো একটা বাচ্চা ছেলে। মৃত্যুভয় মানুষের স্বাধীন চিন্তার উপর প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। একসময় এই ভয়টাই জয়ী হয়। তখন মানুষ আর অন্য কিছু চিন্তা করতে পারে না। সারাক্ষণ তলিয়ে থাকে অন্য একটা জগতে। আসলে সে জগৎটার কি কোন অস্তিত্ব আছে?

মা শরিফকে বড় ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেছে। ফিজিওলজির পাশাপাশি সাইকোলজিতেও ভালো জ্ঞান আছে তার। ডা. বিধানচন্দ্র বললেন, "আসলে ওর সাথে যা হচ্ছে এসব‌ই তার মনের দূর্বল চিন্তা থেকেই হচ্ছে। হয়ত চোখের সামনে এমন অস্বাভাবিক কিছু দেখেছে যার জন্য রীতিমতো ভয় পেয়ে আছে। চিন্তার কিছু নেই। কয়েকদিনের জন্য ক্লোনাজেপাম দিচ্ছি। ঠিক হয়ে যাবে।"

কিন্তু, ডা. বাবু , যদি কিছু নাই হয়, তাহলে কথা বলতে চাওয়ার ব্যাপারটা?"

হ্যাঁ, এটা হতে পারে ওর ঘুমানোর অভ্যাসের জন্য।" " কথাটা ঠিক বুঝলাম না।" 

"ঘুমানোর সময় যদি রেসপাইরেটরি প্যাসেজ, বাংলায় শ্বাসনালীর কোথাও বাধাপ্রাপ্ত হয় তখন দম বন্ধ হয়ে আসতে থাকে। তখন ঘুমের ঘোরেই হা করে নিঃশ্বাস নেয়ার চেষ্টা করে। তখন মস্তিষ্কের নিউরণগুলো আরো উত্তেজিত হয়ে উঠে। শরীরের পেশিগুলোর সাইটোকাইনেটিক এক্টিভিটি বেড়ে যায়। তখন শরীরের মাংসপেশী শক্ত ও নরম হতে থাকে। যার ফলে শরীরে ঝাঁকুনির সৃষ্টি হয়। আপনি এসব নিয়ে চিন্তা করবেন না, ঠিক হয়ে যাবে । আপনি চেষ্টা করবেন ও যেন সবসময় আনন্দে থাকে।"

কিছুটা উৎকণ্ঠা আর উদ্বেগ নিয়ে বাড়ি ফিরে এলো। মনে হলো ঘুমের ওষধে কাজ হয়েছে কিছুটা।

তিনদিন পর শরিফকে আবার বন্ধুদের সাথে খেলার মাঠে দেখা গেলো। শরিফের অসুস্থতায় সবাই দেখতে এসেছিল, কেবল একজন ছাড়া। সগীর। অথচ এই ছেলেটিই সবচেয়ে তার কাছের বন্ধু। একসাথে ঘুরাঘুরি থেকে শুরু করে সর্বক্ষণের সাথী ছিল। স্কুলে কখনো ওয়াশরুমে যাওয়ার দরকার হলেও একজন আরেকজনকে ডেকে নিয়ে যেত। লম্বা, ছিপছিপে, শ্যামলা বর্ণের ছেলেটি দেখতে অনেকটা সাদাসিদেই মনে হয়। কিন্তু ভেতরে ভেতরে ছেলেটি অনেক পেঁকে গিয়েছিল। তার হাত ধরেই শরিফ প্রথম সিনেমা হলে গিয়েছে, প্রথম সিগারেটে টান দিয়েছে। শরিফ কে হঠাৎ মাঠে দেখে সগীর এগিয়ে আসলো। " কিরে বেটা শরীর কেমন?" তারা আবার অন্তরঙ্গ হয়ে উঠলো।

নবম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষার ফলাফলে শরিফ এক থেকে চৌদ্দতে নেমে আসলো। বাসায় একটু বকাঝকা শুনতে হয়েছিল বটে, দু দিনেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে উঠলো। দিনের পর দিন সগীরের সাথে ঘনিষ্ঠতা বেড়েই চলল। ধীরে ধীরে তুখোড় ধূমপায়ী হয়ে উঠলো। বাবা মায়ের অবাধ্য হয়ে উঠতে লাগলো। শরিফের ভুত ছেড়েছে বটে, কিন্তু মানসিক ভুত যে জেঁকে বসেছে। তা কে কি করে ছাড়াবে?

ভেতরে ভেতরে সগীর প্রতিশোধ স্পৃহার অনলে পুড়ছিল। সমস্যা তেমন গুরুতর না, পছন্দের রিতুর সামনে গর্ধভ বলেছিল। সেদিন অপমানে মাথা দশফুট মাটির গভীরে ঢুকে গিয়েছিল। বয়সের দোষে সগীরের রক্ত টগবগ করে ফুটতে শুরু করে দিলো। শরিফ ভালো ছাত্র, তাই সবাই গা ঘেঁষে চলতে চাইত। বিশেষ করে মেয়েরা। সগীর ভবঘুরে হলেও ভদ্র ছেলেই ছিল। কিন্তু, প্রিয়জনের কাছে অপমান সহ্য করতে পারলো না। খুনখারাপি করার চেয়ে প্রতিশোধের উত্তম উপায় হচ্ছে ভিকটিমের জীবন রোলারের মতো উল্টো দিকে ঘুরিয়ে দেয়া। তিল তিল করে পিষে ফেলা। পৈশাচিক আনন্দ পাওয়ার এই একটা মাত্র উপায়।

বন্ধুত্বের ছলাকলায় শরিফ কবে যে বিপথে গিয়ে আসক্ত হয়ে পড়ছে, বুঝতেই পারে নি। পরিবারের সাথে দূরত্ব বাড়তে থাকলো। জীবন মোড় নিতে শুরু করলো একেবারে এক ভিন্ন জগতের দিকে। সগীর সফল হয়েছে, এবার পেছন থেকে কেটে পড়া যায়। খাপছাড়া জীবনের হাল থাকে না, টালমাটাল হয়ে চলতে থাকে যেদিকে খুশি সেদিকে।

পাঁচ বছর শরিফের সাথে যোগাযোগ করেনি সগীর। শরিফ কোন রকমে স্কুল, কলেজ জীবন শেষ করে ভর্তি হয়েছে একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এতদিন চুরুটের মধ্যেই জীবন সীমাবদ্ধ ছিল। সিগারেটের ধোঁয়ার কুণ্ডলীর সাথে অন্তরের গহীন চিন্তাগুলো মিশে উবে যেতে লাগলো। পড়ে র‌ইল অঙ্গারের মতো এক বিধ্বংসী অন্ধকার সত্ত্বা। সেই সত্ত্বা একদল কুচক্রী দ্বারা প্রভাবিত হয়ে এক নারকীয় বিস্ফোরকে রূপ নিলো।

১ জুলাই ২০১৬; রাত ৮:৪৫ মিনিট। তার একটু পর ৯:২০ মিনিট। গুলা গুলির শব্দে ৭৯ নাম্বার রোডের বাসিন্দারা আতঙ্কিত। ৭১ এর বিভীষিকা এই অদেখা মানুষগুলো অনুভব করা শুরু করে দিয়েছে। রহিমাদের জানালার কাঁচ ভেঙে ঢুকে পড়লো একটা গুলি। গুলিটি ভেতরের দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে মাটিতে টং শব্দতুলে গড়িয়ে যেতে লাগলো। রহিমার হৃদপিন্ড রীতিমতো তবলা বাজিয়ে যেতে লাগলো। একমাত্র মেয়েকে জড়িয়ে ধরে নিচু হয়ে বসে র‌ইলো। সে রাতে ১৮ জন বিদেশিসহ ২২ জনের পিঞ্জিরা খালি করে পাখি মুক্ত আকাশ পানে উড়াল দিলো। যারা মুক্তি পেলো না তাঁরা ছটফট করতে লাগলো। খাঁচার মধ্যে ডানা ঝাপটানোর শব্দ মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়লো এক দেশ থেকে অন্য দেশ। জঙ্গি আতঙ্কে কালো অধ্যায়ে নাম উঠলো বাংলাদেশের‌ও। মধ্যে প্রাচ্যে যার উত্থান সেই ধর্মান্ধ, ব্রেইন ওয়াশিং সংস্থাটি গোটা বিশ্বের মাইগ্রেন হয়ে ধরা দিয়েছে। কচি তাজা ফুলগুলো উপড়ে ফেলে দিয়ে, শতশত ফুলের বাগান নষ্ট করছে। ধ্বংস করছে তাজা প্রাণ। গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারি আজ‌ও সেই দিনটির কথা মনে করে।

২৭ নভেম্বর ২০১৯, বিশেষ আদালত সাতজনের মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করে। সেই তালিকায় শরিফের নামটিও আছে। তবে একটু রংচঙ মাখিয়ে লম্বা অক্ষরে লেখা, শরিফুল ইসলাম খালিদ। 


----------------------*****---------------------




ফেরদৌস হাসান মিঠুন

ভেটেরিনারি অনুষদ,

লেভেল-৫ ; সেমিস্টার-১

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ।

রচনা: ৩১ ডিসেম্বর ২০২০ ইং।


লেখকের কথা: শরিফুল ইসলাম খালিদের পেছনের জীবনের সাথে গল্পের প্রথমদিককার কাহিনীর কোন মিল নেই। গল্পকে ছোটগল্পে রূপ দিতে গিয়েই ভিন্নধর্মী কাহিনীর অবতারণা করতে হয়েছে। শরিফ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র ছিল। হলি আর্টিজানের ঘটনার আগেও সে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক প্রফেসরকে কুপিয়ে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় যুুুক্ত ছিল । তরুণ প্রজন্মের প্রতি এই গল্পের মাধ্যমে এটাই বুঝাতে চেয়েছি, " তুমি কার সাথে মিশছো, কার সাথে তোমার সখ্যতা গড়ে উঠেছে, কার দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছো" এসব কিছুই নিজেকে প্রশ্ন করার মাধ্যমে উত্তর খুঁজে নেয়া উচিত। সাময়িক আহ্লাদের জন্য নিজেকে সস্তা করে দিয়ো না। মানুষ হিসেবে জন্মেছি , মানবতার শিকলে আবদ্ধ থাকার যে মনোবৃত্তি তা আমাদের ধারণ করতে হবে। ভালো থাকুক, ভালো কাটুক, প্রতিটি মানুষের প্রতিটা মুহূর্ত। 

Ferdous Hasan Mithun

How Will You Isolate and Characterise Salmonella spp. from Beef?

Isolation and Molecular Characterization of Salmonella spp. from Beef. Author:  Ferdous Hasan Mithun* Introduction: Innumberable foodborne z...